লাশের সাথে কথোপকথন

নির্বাক হয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছি লাশগুলোর ছবিতে। ওরা কথা বলছে, কি যেন বলতে চাচ্ছে আমাদের। সম্ভবত তাঁদের ছাত্রদেরকে কোন শেষ উপদেশ দিচ্ছে। আমাদেরকে শেষ কোন হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছে। সন্তানদের কারও হাতে তুলে দিতে চাচ্ছে। না হয় শাসকগোষ্ঠীর কাছে কোন অভিযোগ করছে। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলছে, আমরা বেঁচে থাকতে চাই। আমরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে পড়াতে যেতে চাই। স্কুল থেকে প্রিয় পরিবার সন্তানাদির কাছে ফিরে যেতে চাই। আমরা যে সারা জীবন তোমাদের, তোমাদের সন্তানদের কে পড়িয়েছি, মানুষ করার চেষ্টা করেছি তার বিনিময়ে আমরা আর কিছু চাই না, শুধু আমরা বাঁচতে চাই। আমাদের বাঁচার সুযোগ করে দাও।

নাকি বলছে, আল্লাহ তুমি আমাদেরকে যে মৃত্যু দিয়েছো তাতে আমরা সন্তুষ্ট। তোমার হুকুম আমাদের জন্য চির ধার্য। আমরা তোমার হুকুম মেনে তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলাম। নিশ্চয় তুমি আমাদের জন্য মাটির উপরের চেয়ে নিচকে উত্তম মনে করেছ। আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ এই জন্য যে, এই মানুষরূপীদের থেকে আমাদের দুরে কোন শান্তির ঠিকানায় পাঠাচ্ছ। চিরস্থায়ী জান্নাতকে আমাদের জন্য উত্তম আবাস্থল হিসেবে পছন্দ করেছ। আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ যে দুনিয়ার এই মানুষগুলোর সাথে আর আমাদের কোন লেনাদেনা নেই, আর কোন আচার অনুষ্ঠান নেই।

আর আমরা লজ্জায় নিচু হয়ে তাদের কোন কথার উত্তর দিতে পারছিনা।

নদীর স্রোতের সাথে শুধু ওসমান স্যার, ইউসুফ স্যারেরা ভেসে যায়নি সাথে ভেসে গেছে আমাদের বিবেক আর মনুষ্যত্বও। ভেসে বেড়ানো লাশগুলো রাতে স্বপ্নের মাঝে জেগে উঠছে। লাশগুলোর রক্ত চক্ষু আমাদের সাথে কথা বলছে, ধিক্কার দিচ্ছে আমাদের। লজ্জায় আমাদের ঘুম আসেনা। আমরাও জেগে থাকি লাশগুলোর সাথে। কথা বলি, অভিযোগ শুনি। হাশরের ময়দানে এই লাশ গুলো আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলবে। সাক্ষী দিবে আমাদের বিপক্ষে। আমরা যে তাদের জন্য বাস যোগ্য ভূমি রেখে যেতে পারিনি। তাদের সুন্দর হাসির বদলে আমরা তাদের দিয়েছে যন্ত্রণার মৃত্যু। তাঁরা সেদিন শহীদ বেসে হাস্যোজ্জ্বল থাকবে। আর আমরা? আল্লাহ আমাদের মাপ করুন।

আজ আমরা কাঁদছি, কাল থেকে আবার চির চেনা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাব। ভুলে যাব লাল বোটের কথা, সাগরের কথা। ওসমান স্যার, ইউসুফ স্যারের কথা। আবারো ঠিক এমন কোন ঘটনার মধ্য দিয়ে মনে পড়বে, আবারো ভুলে যাবো।

কিন্তু যে সন্তান তার বাবা হারিয়েছে, যে মা ছেলে হারিয়েছে, যে স্ত্রী স্বামী হারিয়েছে শুধু তার পরিবারের সারা জীবনের কান্না হয়ে থাকবে। তারা মৃত বাবার কোন পুরাতন শার্ট ধরে, বাবা যে বালিশে ঘুমাতেন সে বালিশ আঁকড়ে ধরে কাঁদতে থাকবে সারাজীবন। যে ওসমান স্যার অনেক গরীব ছাত্রকে পয়সা ছাড়া পড়িয়েছে, তার সন্তানদেরকেই হয়তো একদিন টাকার অভাবে পড়াশুনা বন্ধ করে দিতে হবে। অন্যের কাছে টাকা ধারদেনা করে তাদের জীবিকা চালাতে হবে। স্কুলের খাতায় বাবার নামের আগে মৃত কথাটা লিখতে হবে। সেই ছেলেই বড় হয়ে আমাদের জিজ্ঞাসা করবে, তোমরাই তো আমার বাবাকে মেরেছ, আমাদের এতিম করেছ। তোমাদের আমি ঘৃণা করি। তোমাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।

হযরত ওমর (র) উক্তি, ফোরাত নদীর তীরে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মরে যায় সে জন্য আমি ওমরকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সেই ওমরের উত্তরসূরি আজকের মুসলমানেরা নদীর বুকে লাশ খুঁজে বেড়ায় শুধুমাত্র তাদের অবহেলা আর অকৃতজ্ঞতা বোধের কারণে।

ওসমান স্যার, ইউসুফ স্যারেরা মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন। এখন আমরা কিভাবে বাঁচবো সেটা দেখার পালা।

আল্লাহ উনাদের জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় দাখিল করুন। উনাদের মৃত্যুকে শহীদি মৃত্যু হিসেবে কবুল করুন।

হযরত জাবের বিন আতীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসুল (স:) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করা ছাড়াও সাত প্রকার শহীদ রয়েছে।
১-মহামারীতে মৃত্যুবরণকারী শহীদ। ২-পানিতে নিমজ্জিত শহীদ। ৩-শয্যাশায়ী অবস্থায় মৃত শহীদ। ৪-পেটের রোগ মৃত্যুবরণকারী শহীদ। ৫-অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তি শহীদ। ৬-যে ব্যক্তি ধ্বংসাবশেষের নিচে পড়ে মারা যায় সেও শহীদ। ৭-সন্তান প্রসব করতে মারা যাওয়া নারীও শহীদ। (মুয়াত্তা মালিক-৫৫৪/৮০২)

সাথে সাথে আল্লাহ আমাদেরও ক্ষমা করুন। (আমিন)

লেখা: রাশেদুল হায়দার

২০১৭ সালের ২রা এপ্রিল সন্দ্বীপ গুপ্তছড়া ঘাটে লাল বোট দুর্ঘটনায় যাদেরকে হারিয়েছিলাম তাদের মধ্যে ছিলেন আমাদের প্রিয় ব্যক্তি ‘ওসমান স্যার’ যিনি আমাদের পরিবারের অনেক কাছের লোক ছিলেন। আমাদেরকে ছোট বেলাতে প্রাইভেট পড়ানো সহ অনেক গাইডেন্স করেছেন। অন্য আরেক জন হলেন প্রিয় ছোট ভাই ‘ইউসুফ’ সার সাথে প্রাই আমার ফোনে কথা হত, তার বাড়ি আমাদের বাড়ির পাশে ছিল। এবং আরেক বন্ধু ‘জোবায়ের’ যে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিলো, যার সাথে ২০০৬ পর্যন্ত এক সাথে পড়াশুনা করেছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Recent Post

শুভ জন্মদিন ২০২২

আজ আমার তেত্রিশ মতান্তরে পঁয়ত্রিশতম শুভ জন্মদিন! (বয়সে করোনাকালিন হিসেব বাদ দেয়া হয়েছে) ছবিটি আনুমানিক ২০ বছর আগের হারিকেন জমানার। ছত্রিশ ফিল্মের কোডাক ক্যামেরার। মেঘে মেঘে বয়স তো আর কম হলো না। সেই ১৫ টাকা সের চাল সময়কার ছেলে আমি। ৪০ টাকা নিয়ে বাজারে যেতাম। এর মধ্যে মাছ-তরকারি, মুদি সদায় সহ দুই টাকা বাঁচিয়ে .....

বই: প্রোডাক্টিভ মুসলিম

বইটি পড়ে কিছু ব্যাপারে আচার্য হয়েছি। বইটি হাতে নিয়ে পড়ার আগে মনে করেছিলাম, এর ভিতরে লেখা থাকবে শুধু কাজ আর কাজ। কিসের ঘুম, কিসের বিশ্রাম আর কিসের অবসর। হয়তো বলা থাকবে, এই দুনিয়াতে কি শুধু ঘুমাতে আসছেন। শুধু কাজ করেন আর অন্য কিছু নয়। পরবর্তীতে ঘুমের উপর চ্যাপ্টার পড়ে আরও বেশি আচার্য হয়েছি যে, .....

বই: ইন দ্য হ্যান্ড অব তা-লে-বা-ন

১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। মঙ্গলবার। নিউইয়র্ক-বাসীর সকালটা শুরু হয় অন্যান্য দিনের মত! সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা নিউইয়র্কের লোকজন খুব সকালে উঠে যার যার অফিস শুরু করেছে। প্রতিদিনকার সকালের মত হয়তো কেউ কেউ চা-কপি দিয়ে মাত্র অফিস ডেক্সে ওইদিনের মত নিজেকে সেট করে নিচ্ছে। পৃথিবীকে নাড়া দিতে যাচ্ছে এমন কোন ঘটনা ঘটতে চলেছে তখনও এই .....

বই: ফজর আর করব না কাজা!

আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম! মাত্র ফজরের আজান হয়েছে। সামনের বাসার আঙ্কেলের বড় গেটের তালা খোলার খটখট আওয়াজ। তারপর আমার মোবাইলের এক নাম্বার এলার্ম ভেজে উঠলো। একরাশ বিরক্তিসহ এলার্ম বন্ধ করলাম। এই আলতো ঘুমের এমন ঝনঝন তালা খোলার শব্দ আর এলার্মের এমন ভিট-ঘুটে আওয়াজ সত্যিই বিরক্তিকর ছিলো। তারপর কোন রকম উঠে দায়সারা ভাবে নামাজ ঘরে .....

বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ রিভিউ: এ আমি কি দেখলাম?

অফিস থেকে মনে হয় একটু তাড়াহুড়া করেই বের হয়েছি। আজকে বাংলাদেশের চির প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলা। কয়দিন আগেও এই অস্ট্রেলিয়াকে মিরপুরের মাঠে আমরা কচুকাটা করেছি। সেই হিসেব মতে আজ একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই উপভোগ করবো। টানটান উত্তেজনা থাকবে। বাংলাদেশ হাড় কাঁপানো ব্যাটিং করবে। মাঠ কাঁপানো ফিল্ডিং করবে। টানটান করে বাউন্ডারি হাঁকাবে। দর্শক সাড়ি থেকে বাংলাদেশ! .....

নাফাখুম জলপ্রপাত – নেটওয়ার্কের বাইরে একদিন

আজকে যাবো। কালকে যাবো। এই বর্ষায় যাবো। এমন করতে করতে এক ট্যুরের প্ল্যান চলে প্রায় দুই বছর ধরে। এর মধ্যে করোনা। লকডাউন। শাটডাউন। মাস্ক। স্যানিটাইজার ইত্যাদি ইত্যাদি পৃথিবীতে নতুন করে আগমন করেছে। অন্যদিকে নাই হয়ে গেছে অনেক পরিচিত মানুষ, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-অনাত্মীয়। প্রতি বছর একটা জংলী ট্যুর দেয়ার ইচ্ছে থাকে। বড়সড় একটু গ্রুপ করে কোন .....

All Post